ঢাকা, ০৫ মে, ২০২৪ | বৈশাখ ২২ ১৪৩১
ঢাকা, ০৫ মে, ২০২৪       
banner

একজন রত্নগর্ভা মায়ের প্রস্থান

হারুন আনসারী বঙ্গবাণী

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৪ আগস্ট ২০২১

একজন রত্নগর্ভা মায়ের প্রস্থান

হারুন আনসারী

আমি একটা সমৃদ্ধ ছোটকাল পেয়েছিলাম। বিত্ত কিংবা ঐশ্বর্য নয়; আমার এ সমৃদ্ধ সুখ ছিলো মায়ামাখা মমতাময়ী কিছু মায়ের বদৌলতে। গতকাল তেমন একজন মমতাময়ী মায়ের মৃত্যুর খবরে আমার সেই শৈশবের কথা মনে পড়ে গেলো।

শহরের পূর্ব খাবাসপুরের একেবারে শেষ মাথায়, কুমার নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে মৃধা বাড়ি। সেখানে আমি যেতাম খুব ছোটবেলা হতেই আমার সহপাঠী বন্ধু কাবুলের সাথে। তবে আরো একটি কারণেও ওই বাড়ির অন্দর মহলে আমার যাতায়াত ছিল সেই ছোটকালেই। 

কাবুলের আব্বা মৃধা বাড়ির অ্যাডভোকেট আব্দুল আলী মৃধা চাচা ছিলেন আমার আব্বার বন্ধু, খুবই ঘনিষ্টজন। কাবুলের নানা বাড়ি হচ্ছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ব্যাসপুর গ্রামে। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তিনি। আর আমার দাদা বাড়ি একই উপজেলার ভাট্টাইধোবা গ্রামে।

ছোটবেলায় যখন ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জের পথে বাস চলাচল ছিলোনা, তখন নৌকা আর ট্রেনই ছিলো একমাত্র ভরসা। ট্রেনে করে গ্রামে যেতে আমরা এই ব্যাসপুর স্টেশনে নামতাম। তারপর মাইলের পর মাইল কখনো শুকনো বিল পাড়ি দিয়ে, কখনো মাটির রাস্তা হেটে বাড়ি পৌছাতে সেই সন্ধা। এজন্য ব্যাসপুর নামটি স্মৃতিতে সেঁটে গেছে। এরপর যখন ট্রেন বন্ধ হলো, বাস চলতে শুরু করলো তখনও সেই ব্যাসপুর স্ট্যান্ডেই নামতে হতো। তারপর ভ্যানে করে বাড়ির পথে যাত্রা।

সেই ব্যাসপুর গ্রামের বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা আব্দুল হালিম সাহেবের নাম দেশের অনেকেই শুনেছেন। এই হালিম সাহেবের বোন হচ্ছেন আমার বন্ধু কাবুলের আম্মা। আমি যাকে খালাম্মা বলতাম। একজন নারী তাঁর কর্ম ও চরিত্রের মাধুর্য গুণে নিজেকে মর্যাদা ও সম্মানের কতোটা উচ্চ আসনে আসীন করাতে পারেন সেটি খালাম্মাকে দেখলে অনুধাবন করা যায়।

কুমার নদী পাড়ে কাবুলদের বাড়ির বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ছিলো আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, জামরুল, পাইন্যাল, কাঠাল, ডাব, নারকেল সফেদা সহ নানা ধরনের ফলের গাছ। সম্ভবত একটি করমচা ফলের গাছও ছিলো। আর ছিলো বাড়ির প্রবেশ মুখে মিষ্টি ঘ্রাণের কাঠালচাঁপা ফুলের গাছ।
আমরা স্কুলের বন্ধুরা ওদের বাসায় যেতাম এইসব মধুময় ফলের আকর্ষণে। গাছের ফল পাঁকলে কাবুলের সাথে স্কুল শেষে দলবেঁধে আমরা বন্ধুরা যেতাম ওদের বাড়ি। 

আমি, মাসুম, হিল্লোল, কল্লোল, বাকি বিল্লাহ, মিরাজ, টুটুল, ফুয়াদ, নোমান,  মঞ্জু, সাব্বির, বাবুল, মইনুল। তারপর ইচ্ছেমতো কেউ গাছে উঠে, কেউবা মজা করে ঢিল ছুড়ে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতাম। কখনো খালাম্মা ঘরের মধ্যে থেকে আগে থেকে পেড়ে রাখা ফল এনে খেতে দিতেন। কাঁচা আম কেটে মেখে দিতেন। আপন সন্তানের মতোই দরদমাখা হাতে আমাদের খেতে দিতেন। খালাম্মার এই ভালোবাসায় মনে হতোনা এটি কোন বন্ধুর বাড়ি। মনে হতো নিজেদেরই বাড়ি। তাই তাঁর এই ব্যবহারের সাথে আপন মায়ের মমতার কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনি।

একটি সম্ভান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে তিনি মানুষের প্রতি ঔদার্য প্রদর্শন কিংবা সাহায্য সহযোগিতা করার মানসিকতাকে পারিবারিকভাবেই আত্মস্থ করতে শিখেছিলেন।
মানুষের বিপদে-আপদে তিনি সবসময় ছিলেন উদারহস্ত, অকৃপণ।

আমরা যখন ছোট, প্রাথমিকের ছাত্র; সেই তখনই মৃধা চাচা মারা যান। তারপর সুদীর্ঘকাল তিনি সন্তানদের বুকে আগলে প্রত্যেককেই উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বলতে দ্বীধা নেই, তাঁর প্রত্যেকটি সন্তানই মেধাবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাবার অবর্তমানে সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার এই পুরো কৃতিত্বই আমি এককভাবে খালাম্মাকেই দিবো। সেদিক দিয়ে তিনি একজন রত্নগর্ভা মা।

তাঁর বড় সন্তান মাহবুবুর রহমান কামাল যাকে এই শহরের সকলেই প্রায় চিনেন। এই শহরে যার হাতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রী। ইউনিভার্সেল একাডেমীর মাধ্যমে যিনি সর্বপ্রথম এই শহরে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের দাবিদারও বটে।

তাঁর আরেক সন্তান বিসিএস ক্যাডার হয়ে বর্তমানে প্রথম শ্রেণির একজন সরকারী কর্মকর্তা। আর সবার কনিষ্ঠ আমার বন্ধু কাবুল এই অল্প বয়সেই একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
শিক্ষা কিংবা কর্মজীবনের চাইতেই বড় কথা হচ্ছে, মৃধা চাচার অবর্তমানে খালাম্মা তাঁর সন্তানদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন যারা শিক্ষার্জনের পাশাপাশি নৈতিক, মানবিক ও চারিত্রিক ক্ষেত্রেও উন্নতি লাভ করেছেন।

যারা এই সন্তানদের ব্যক্তিগতভাবে চিনেন তারা কেউই আমার সাথে তাদের এসব গুনাবণীর ব্যাপারে দ্বীমত হবেন না এটি আমি হলফ করে বলতে পারি। শুধুমাত্র নিজের সন্তান বা পরিচিতদের কাছেই নয়, খালাম্মা আসলে সন্তানতূল্য অপরিচিতদের কাছেও মমতাময়ী, দরদী ও স্নেহময়ী মায়ের মতোই ভালবাসা বিলিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ফেসবুকে পোস্ট করার পর অনেকের মন্তব্যে তারই বহিঃপ্রকাশ দেখেছি গতকাল।

সবার অজান্তে শুধুমাত্র স্রষ্টার ভালবাসায় যারা নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেননা, খালাম্মা ছিলেন তাঁদেরই একজন। অনেক সমৃদ্ধ ছিলেন কিন্তু কোন অহংকার করতেন না। সবসময় সবাইকে সদুপদেশ দিতেন।

এমন একজন রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান হতে পারা সত্যিকারেই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সন্তানদের নিয়ে তাঁর স্বামীহারা জীবনের এই কঠিন সংগ্রামের সময়গুলোর কথা যদি ভাবতে যাই, তাহলে একদিকে যেমন অশ্রুতে চোখ ভিজে আসে, অন্যদিকে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক এবং পর্দানশীন ছিলেন। অত্যন্ত সুবিবেচক, সুচিন্তক ছিলেন। কামাল ভাইয়ের লেখায় পড়লাম, চলমান করোনাকে তিনি আমাদের কর্মফল হিসেবে মন্তব্য করে গেছেন।

আমি তাঁর এই বিবেচনাবোধে আশ্চর্য হইনি, বরং গর্বিত বোধ করেছি যে, তিনি দুনিয়ার হালহকিকত সম্মন্ধে বৃদ্ধাবস্থাতেও বেখবর ছিলেন না। এই সমাজ সচেতন নারীদেরই আসলে আমাদের প্রয়োজন ছিলো। যারা অধঃপতিত সমাজকে টেনে তুলতে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করে যেতে পারেন।

আরেকটি কথা, সন্তান যেমন মায়ের কাছে কখনো বড় হয়না, তেমনি মায়ের বয়স হয়েছে চলে যাওয়ার, এটিও সন্তানের বিশ্বাস হয়না। তাই শতবর্ষী মায়ের মৃত্যুতেও সন্তানের মন কাঁদে। মা-হারা এই সন্তানদের সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষা হয়না। তবে মৃত্যু যাদের কাছে স্রষ্টার সান্নিধ্যে জান্নাতের হাতছানি; তাদের সন্তানদের মন খারাপ করার কিছু নেই। এমন সৌভাগ্যের জীবন ক'জনার কপালে জুটে?

মায়ের নাম মুখে নিতে নেই। ছোটবেলা হতে এমনটাই জেনেছি। কারণ মাকে কখনো নাম ধরে ডাকা যায়না। মা'তো মা'ই। আমি আমার মাকে কোনদিন মা বলে ডাকিনি। ডাকতাম আম্মা বলে। বাসার রীতিই ছিলো এমন। সব ভাইবোন মা'কে আম্মা বলেই ডাকতো।
আমি কোনদিন আম্মাকে তুমি বলেও ডাকিনি। সবসময় আপনি বলতাম। বাসার সব ভাইবোনও তেমনটিই বলতো।

আমাদের আশেপাশে অনেকে মায়ের বোনকে খালা বলে ডাকে। আমি কোনদিন আমার মায়ের কোন বোনকে খালা বলে ডাকিনি। মায়ের বোন না হয়েও যারা আমার খালার মতো মনে হতো আমি তাদেরও খালাম্মা বলতাম। আমার তেমনই একজন খালাম্মা ছিলেন ছোটবেলার সহপাঠী বন্ধু কাবুলের আম্মা।

কাবুলের আব্বা অ্যাডভোকেট আব্দুল আলী মৃধা সাহেব। আমি মৃধা চাচা বলতাম। আমি যখন অনেক ছোট তখন মৃধা চাচা ইন্তেকাল করেন বলে খুব বেশি স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে কাঠপট্টিতে চাচার চেম্বার ছিলো। আমি আব্বার সাথে সেখানে যেতাম। আমার মুসলমানিতে তিনি উপহার নিয়ে এসেছিলেন এই স্মৃতিটা খু্ব মনে আছে। সেই স্বল্প বয়সে বাবা হারানো বন্ধু আমার এখন মা হারিয়ে যেই দুঃখের সাগরে মন ভেসে গেছে, সেখানে আসলে দুঃখ নয় বরং জান্নাতের সুঘ্রাণ মিলে।

দয়াময় আল্লাহ খালাম্মাকে ও মৃধা চাচাকে তাঁদের উত্তম প্রতিদান দান করুন। তাঁদেরকে জান্নাতে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। এই বিদায়লগ্নে এটুকুই আমার প্রার্থনা। আমীন। 

লেখক: সাংবাদিক

বঙ্গবাণীডটকম/এমএস