ঢাকা, ০৩ নভেম্বর, ২০২৪ | কার্তিক ১৯ ১৪৩১
ঢাকা, ০৩ নভেম্বর, ২০২৪       
Shruhid Tea

সালথা তান্ডবের এক বছর

ওসির বিরুদ্ধে কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ

নুরুল ইসলাম, সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি বঙ্গবাণী

প্রকাশিত: ০০:০৯, ৫ এপ্রিল ২০২২

ওসির বিরুদ্ধে কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ

সালথা থানার ওসি মো. আশিকুজ্জামান

ফরিদপুরের সালথা উপজেলা পরিষদ, ইউএনও অফিস ও বাসভবন এবং সালথা থানা ভবনে তান্ডবের ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ (৫ এপ্রিল) মঙ্গলবার। গত বছর এই দিন সন্ধা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত সালথার গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে সরকারি এসব ভবনে তান্ডব চালায়। 

এ সময় আগুন ধরিয়ে দেয় দুটি সরকারি গাড়িসহ বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে। এই ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে দুটি মামলার বাদী পুলিশ। মামলাগুলোকে পূজি করে গত এক বছরে সালথা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে।

এই বছরটি সালথাবাসীর কাছে মুর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল ওসি। তিনি তান্ডবের ঘটনায় শতশত মানুষকে জিম্বি করে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছিলেন অমানুষিকভাবে। মামলা-রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ওসির ভয়ে সাধারন মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়। 

যোগদানের এক বছর পার হওয়ার সেই বিতর্কিত ওসির বদলির খবরে আনন্দের জোয়ার বইছে সালথাবাসীর মধ্যে। ওসিকে ঢাকা অর্মড পুলিশ হেকোয়ার্টারে বদলি করা হয়েছে। আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার কথা।    

এলাকাবাসী সুত্রে অভিযুক্ত ওসির বিষয় জানা গেছে- গেল বছর ১ এপ্রিল সালথা থানার ওসি হিসেবে যোগদান করেন মো. আশিকুজ্জামান। যোগদানের পর প্রথম দিন তিনি নিজেকে একজন সৎ মেধাবী পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে এলাকাবাসী একটি বার্তা দেন। তা হলো- থানায় মামলা বা অভিযোগ করতে কোনো টাকা-পয়সা লাগবে না। লাগবে না থানায় ঢুকতে কারো অনুমতি। এমন একটি বার্তা কাগজে লিখে থানার দেয়ালে দেয়ালে টানিয়েও রাখেন। 

ধর্মীয়ভাবেও তার জ্ঞানের অভাব ছিল না তার। প্রতি শুক্রবার ১২ টার মধ্যে ওসি পাঞ্জাবি-টুপি পড়ে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে ভালো ভালো ধর্মীয় কথা শুনাতেন মুসল্লিদের। নানা বিষয়ের উপর সচেতন করতেন। পাশাপাশি থানায় সেবা নিতে কোনো দালাল বা কাউকে একটি টাকাও দিতে নিষেধ করতেন। থানায় সেবা নিতে কেউ টাকা-পয়সা চায় কি না, তাও জানতে চাইতেন। যেকারণে গ্রাম এলাকার সাধারন কিছু সহজ-সরল মানুষের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি। 

কিন্তু গত ১৪ মার্চ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে- চাঁদা না দেওয়ায় উপজেলার ভাবুকদিয়া গ্রামের জিহাদ নামে এক ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে ধরে এনে থানা আটকে রেখে নির্যাতনের। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী মামলা হয়। লিখিত অভিযোগ যায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়। অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন। 

এরপর একে একে বেরিয়ে আসে ওসির আসল ভয়ঙ্কর রূপ। সরকার দলীয় নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সাধারন মানুষ মূখ খুলতে শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে ওসির ঘুষ-বাণিজ্য, আটক-বাণিজ্য, সাধারন মানুষকে নির্যাতন ও প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ। ইতিমধ্যে ওসির ঘুষ-বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের বিষয় তথ্যের খোজে মাঠে নেমেছেন জেলা পুলিশ। 

এলাকাবাসী সুত্রে আরও জানা গেছে- ওসি থানায় যোগদানের চারদিন মাথায় ৫এপ্রিল লকডাউনের মধ্যে সালথা এলাকায় জরিমানা আদায় নিয়ে ম্যাজিট্রেট ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয় এলাকাবাসীর। সেই ঘটনায় সালথার গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে সালথা ইউএনও অফিস ও বাসভবন, সালথা থানা ও উপজেলা ভবনে তান্ডব চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

তান্ডবের ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়। মামলাগুলোকে পুজি করে সালথাবাসীকে জিম্বি করে ফেলেন ওসি।  হত্যা, চুরি, ছিনতাই, মাদক, পারিবারিক, জমি সংক্রান্ত ঝামেলা, ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি ও সংঘর্ষসহ যেকোনো ঘটনায় যে কেউ থানা পুলিশের হাতে আটক হলেই তাদেরকে তান্ডবের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখি এবং নির্যাতন করে মোটা অংকের টাকা দাবী করতেন ওসি। যারা টাকা দিতে পারতেন না, তাদেরকেই তান্ডবের মামলায় ফাঁসিয়ে দিতেন। 
জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে এনে ওসি নিজেই করতেন চরম নির্যাতন। আর যারা টাকা দিতেন, তাদের নরমাল ধারায় মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জামিনে আসার সুযোগ করে দিতেন। আবার মোটা অংকের অর্থের বিনিময় অনেককে ছেড়েও দিতেন।     

এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে- মামলাগুলো ছাড়াও তিনি যোগদানের পর থানার দুই এসআইয়ের উপর হামলা ঘটনার মামলা, ৪টি হত্যা মামলা, ইউপি নির্বাচন ও বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনায় লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করেছেন। থানার মধ্যে ঘর নির্মাণের কথা বলে সালথা বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রড, সিমেন্ট, ইট ও খোয়া নিয়েছে ওসি। একই কথা বলে সরকার দলীয় একাধিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। 

সুত্র আরও জানায়- ঘুষ-বাণিজ্যের এসব অর্থ ওসি নিজের হাতে নিতেন না। থানার কার্যালয়েও কোনো লেনদেন করতেন না। সরাসরি তার বাসায় গিয়ে দেন-দরবার করতেন ভুক্তভোগিরা। তার বাসায় রয়েছে একটি কাঠের টেবিল। কাগজের খামের মধ্যে টাকা ভরে ওই টেবিলের ডয়ারে ফেলে আসতে হতো। চুক্তি অনুয়ায়ী কেউ টাকা কম দিলে পরে তাকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ফোন করে ভয়ভীতি দেখাতেন। 

অভিযোগ আছে- ওসি ঠিকমত তার কার্যালয় বসতেন না। লুঙ্গী-গেঞ্জি পড়ে বাসার সামনেই বসে থাকতেন বেশির ভাগ সময়। অপেক্ষায় থাকতেন কখন আসবে ভুক্তভোগী পার্টি। একাধিক ভুক্তভোগির সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

একটি সুত্র থেকে জানা গেছে- ৫এপ্রিল তান্ডবের ঘটনার পর প্রতারনার অভিযোগে আটক হয় সোনাপুরের জোগারদিয়া গ্রামের ফরহাদ মোল্যা। আটকের পর তাকে থানা ভাঙচুরের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ওসি মোটা অংকের টাকা দাবী করে তার পরিবারের কাছে। পরিবারের পক্ষ থেকে ওসিকে প্রথমে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেয়। তারপরেও ফরহাদকে ভাঙচুর মামলায় আসামী করা হয়। ফরহাদ গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে সোনাপুর ইউনিয়নে নৌকার বিপক্ষে চেয়ারম্যান প্রার্থী হলে ওসি তাকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবী করেন। তখন আমিন খন্দকার নামে এক নেতার মাধ্যমে ওসিকে ৫ লাখ টাকা দেয়। 

অপরদিকে ওই ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান বাবু বলেন- নির্বাচনের সময় ওসি আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাধারন মানুষের নানা সমস্যার জন্য থানায় তদবির করা লাগে। সালথার তান্ডবের ঘটনার আসামী আমার ইউনিয়নের ফুকরা গ্রামের ডা. কাউছার ও তার ছেলে টুকুকে গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের অন্য মামলায় আসামী না করার জন্য ওসিকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। মামলায় তাদের রিমান্ডে আনার পর আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। 

ওই গ্রামের আরেক আসামী হাসান মেম্বারের পরিবারের কাছ থেকেও ওসিকে মোটা অংকের টাকা দেয় হয়। তিনি আরও বলেন- মিনহাজদিয়া গ্রামের নজমাল ও তার ভাই বিল্লালকে তান্ডবের মামলায় ফাঁসানোর কথা বলে প্রতিপক্ষের চান মাতুব্বরের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নেয় ওসি। কি বলবো, ওসি টাকা ছাড়া কিছু বুঝে না। তান্ডবের ঘটনায় বিভিন্ন আসামীদের পক্ষে ওসিকে আমি ১০-১২ লাখ টাকা দিয়েছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জনপ্রতিনিধি, সরকার দলীয় নেতা, ও সাধারন ভুক্তভোগী জানান- তান্ডবের মামলার আসামী সালথা গ্রামের আয়ুব মাতুব্বর ও ছেলে ইমরানকে গ্রেফতার না করার কথা বলে তাদের কাছ থেকে ৬ লাখ, অন্য মামলায় দেওয়ার কথা বলে জালালের কাছ থেকে ১ লাখ ও মোস্তফা মাতুব্বরের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নেয় ওসি। তান্ডবের মামলার আসামী বাহিরদিয়া মাদ্রাসার মোহমিম হেফাজত নেতা মাওলানা আকরাম আলীকে গ্রেফতার না করার কথা বলে তার কাছ থেকেও ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ওসি। মামলার আরও দুই আসামী কুমারপট্টি গ্রামের বাসিন্দা বিএনপি নেতা শাহ আলম ও তার ভাই মুক্ত মাতুব্বরকে গ্রেফতারের পর তাদের অন্য মামলায় না দেওয়ার কথা বলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে এই টাকা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুকের মাধ্যমে ওসিকে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

যদুনন্দীর খারদিয়া গ্রামের গ্রাম্য দলনেতা রফিক মোল্যা সংঘর্ষের ঘটনা আটক করে এনে তান্ডবের মামলায় আসামী করার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবী করে ওসি। পরে ওসিকে রফিকের মা জেকেরুন নেছা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়। তারপরেও রফিককে ভাঙচুর মামলা আসামী করে। বিষয়টি রফিকের মা পুলিশের জেলা কর্মকর্তাদের জানালে ওসি তাকে ধরে থানায় এনে টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করিয়ে ভিডিও নেয়। ওই ভিডিও পরে পুলিশের জেলা কর্মকর্তাদের দেখিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবী করেন ওসি। রফিকের একই ঘটনায় সোনাপুর ইউপি চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান বাবুর মাধ্যমেও ১ লাখ নেয় ওসি। রফিক বলেন- তান্ডবের মামলায় আমি জেল থেকে বেরিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। নির্বাচনের সময় ও গত ২৩ অক্টোবর খারদিয়ার গ্রামের মারিজ শিকদার হত্যা মামলা ঘটনায় আমার কাছ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা নিয়েছে ওসি। মারিজ হত্যার মামলার আসামী ইমরুল খার কাছ থেকেও ওসি ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। 

যদুনন্দী ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন কায়ুম মোল্যা। নির্বাচেনর আগে মারামারি ঘটনায় তাকে ধরে এনে তান্ডবের মামলার আসামী করার ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ প্রথমে ৫০ হাজার, পরে আরও ৩০ টাকা নেয় ওসি। তারপরেও তাকে তান্ডবের মামলায় আসামী করে। কায়ুমকে রিমান্ডে এনে নিয়াতন না করার কথা বলে এসআই হান্নান ১০ হাজার নেয়। ওসিকে এসব টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে কায়ুম মোল্যা বলেন- আমি গ্রেফতার হওয়ার আগে থানার উন্নয়ন কাজের জন্য ওসিকে দুই কিস্তিতে ৯০ হাজার টাকা দেই। ইউপি নির্বাচনে কয়েক দফায় ওসিকে আমি ২ লাখ টাকা দেই। টাকা না দিলে আমি এলাকায় ভোট চাইতে পারি না। 

তিনি আরও বলেন- ২৫ ডিসেম্বর সংঘর্ষে গোলাম মওলা নামে আমার প্রতিপক্ষের এক ব্যক্তি নিহত হয়। ওই মামলা থেকে রক্ষা পেতে আমি গাজী কামরুল নামে আমাদের দলের এক লোকের মাধ্যমে ওসিকে ৯০ হাজার টাকা দেই। ওই মামলা থেকে সাজ্জাদ নামে এক যুবলীগ নেতার নাম কাটার জন্য ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমার এলাকার সাইফুল, ইমরান ও মনির শেখ নামে ৩ জনকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে তাদের ৩দিন থানায় আটকে রাখে। এরমধ্যে সাইফুলকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে রাখি। বাকি দুই জনকে ছিনতাই মামলায় জেলে পাঠায়। তিনি বলেন- তান্ডবের মামলাসহ বিভিন্ন বিষয় আমি এই ওসিকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি।

গত ৪ জুন মিলাদ পড়া নিয়ে হামলায় নিহত হয় যদুনন্দী গ্রামের ইদ্রিস কারিকর। এই হত্যা মামলায় যদুনন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রব মোল্যা ও তার ছেলেদের আসামী হলে তাদের গ্রেফতার না করার কথা বলে প্রথমে ৩ লাখ টাকা নেয় ওসি। এরপর তান্ডবের মামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় ভয় দেখিয়ে আব্দুর রব মোল্যার কাছ থেকে কয়েক দফায় ৮-১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। 

রব মোল্যা বলেন- আমার দলের গোলাম মওলা হত্যা মামলা করার সময়ও ওসি দেড় লাখ টাকা নেন। কিন্তু টাকা নিয়ে সে কোনো কাজও করে না।

বল্লভদী ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নুরুল ইসলামের কাছ থেকে নির্বাচনের সময় ওসি ৪ লাখ টাকা নেয়। তার ৪ সমর্থক সালথার তান্ডবের মামলার আসামী। তাদের গ্রেফতার না করার কথা বলে ৫০ হাজার নেয় আমার কাছ থেকে। ওসিকে টাকা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নুরুল ইসলাম বলেন- এই ওসি থানার যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন বিষয় আমার কাছ থেকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়েছে। ওনার মত এত টাকা পাগল ওসি জীবনেও দেখিনি।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে- ওসির নির্দেশে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সংগ্রহ করে থানার পুলিশ সদস্যরা। যাদের আইডি কার্ডের ফটোকপি আনা হয় থানায়,  তাদের তান্ডবের মামলার আসামী করার ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে ওসি নিজে। যারা টাকা না দিয়েছে তাদের নাম মামলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এভাবে শতশত মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে ওসির বিরুদ্ধে।

গত ২৬ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষের হামলা নিহত হয় ভাওয়াল ইউনিয়নের নারানদিয়া প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ মোহাম্মাদ মাতুব্বর। এই হত্যা মামলায় প্রধান আসামী করা হয় নারানদিয়া গ্রামের সাহেব আলীকে। তিনি ঢাকা বইয়ের ব্যবসা করেন। প্রধান আসামী সাহেব আলীকে না গ্রেফতার করার কথা বলে ওসি ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।  

গত ১৫ নভেম্বর রাতে উপজেলার আটঘর ইউনিনের গৌড়দিয়া বাজারের একটি দোকান থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির ৩০ বস্তা চাউল কালোবাজারে বিক্রির ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জসীটে আসামী ডিলার আলিম মোল্যার নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। 

ওসি নানাভাবে কৌশলে ভয়ভীতি দেখিয়ে থানায় ঘর নির্মাণের কথা বলে সালথা বাজারের রড ব্যবসায়ী চান মিয়া কাছ থেকে ৫শ’ কেজি রড, রেজা তালুকদারের কাছ থেকে শতাধিক বস্তা সিমেন্ট ও আয়নাল হকের কাছ থেকে ইট-খোয়া নেয় বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া ঘর নির্মাণের কথা বলে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এভাবেই শতশত মানুষকে জিম্বির করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওসি আশিকুজ্জামান। পুলিশের উপর মহল যদি সালথার ভুক্তভোগী মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চত করে তদন্তে নামে। তাহলে আরও শতশত মানুষ এই ওসির নানা অপকর্ম ও ঘুষ-বাণিজের বিষয় মুখ খুলবে।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সালথা থানার অভিযুক্ত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আশিকুজ্জামান বলেন- সালথায় তান্ডবের ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়েছে, তাতে আমি কাউকে ছাড় দেই নাই। এমনকি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগকেও আমি এই মামলায় গ্রেফতার করেছি। আমি যেহুত কাউকে ছাড় দেই নাই, তাই তারাই আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ রটাচ্ছে। 

ইউপি নির্বাচনে বাণিজ্যে বিষয় তিনি বলেন- সালথায় ইউপি নির্বাচন যে সুষ্ঠ-সুন্দর হয়েছে, তা নজীরবিহীন। নির্বাচনের সময় তান্ডবের মামলার যারা আসামী ছিল বা যারা বিভিন্ন মামলার আসামী ছিল, তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই কারণে অনেকে আমার উপর ক্ষুব্ধ ছিল। যারা ক্ষুদ্ধ ছিল, তাদের অনুসারীদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে এসব কর্মকান্ড ছড়াচ্ছে। আমার চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। আমাকে চাপে ফেলাতে এসব বলা হচ্ছে। আমি নিজে জানি যে, কি কাজ করছি। তবে অনেক দু:খ আর কষ্ট নিয়ে সালথা থেকে বিদায় নিতে হলো আমাকে।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন- ওসি আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশের দুই জন কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনা যেহুত ঘটেছে, তাহলে কিছু না কিছু ঘটেছে। সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। তদন্ত করে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সালথার তান্ডবের ঘটনার মামলার চার্জসীটের বিষয় পুলিশ সুপার বলেন- সালথার ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার চার্জসীট দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো দ্রুত চার্জসীট দেওয়া হবে।  

বঙ্গবাণীডটকম/এমএস/এনআই

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত