ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ | বৈশাখ ৬ ১৪৩১
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪       
banner

আফ্রিকার ফুটবলে কালো জাদু!

খেলা ডেস্ক বঙ্গবাণী

প্রকাশিত: ১৮:০০, ৮ অক্টোবর ২০২০

আফ্রিকার ফুটবলে কালো জাদু!

ছবি-সংগৃহীত

বিশ্বের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা ফুটবল। এ খেলার দর্শকরা বল পায়ে খেলোয়ারদের কারিকুরি দেখতে ভালোবাসেন। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার মত শক্তিশালী না হলেও আফ্রিকার দেশগুলো প্রায়ই নজড়কাড়া পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে থাকে। মহাদেশটির অনেক ফুটবলারই ইউরোপের লিগগুলোর অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তবে যতটা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, ঠিক ততটা এগোয়নি আফ্রিকার ফুটবল। এর পেছনে রয়েছে কালো জাদুর ভয়ংকর থাবা।

বর্তমানে যেকোনো দলেই খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খেয়াল রাখতে ফিজিওথেরাপিস্ট থাকে। ফুটবলে তো এটা একপ্রকার অপরিহার্য অংশ। তবে অবাক হলেও সত্য, একটা সময় আফ্রিকার প্রতিটি দলে কমপক্ষে একজন করে তান্ত্রিক নিয়োজিত থাকতো। এই বাজে রীতি এতটাই মহামারি আকার ধারণ করেছিল যে একসময় এদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় আফ্রিকান ফুটবল এসোসিয়েশন। 

তবে নিষিদ্ধ করলে কি হবে, এখনো আড়ালে-আবডালে ঠিকই চলছে জাদুবিদ্যা। আফ্রিকার দেশগুলাতে সাধারন মানুষের মাঝে জাদুটোনায় বিশ্বাস ব্যাপক হারে প্রচলিত। এই ধারণা থেকে বাদ নেই ফুটবলাররাও। তাই অনেক খেলোয়াড়ই নিয়মিত এই তান্ত্রিকদের শরণাপন্ন হন। 

ফুটবলের মতো অসাধারণ একটি খেলায় তান্ত্রিকের কাজ কি? এ বিষয়ে উত্তর দিয়েছেন নাইজেরিয়ার এক স্থানীয় কোচ মারিউ বাফাংগা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কালো জাদুর ব্যাপারটা আসে মূলত হিংসা থেকে। নিজেদের পারফরম্যান্সের উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দেরকে ঘায়েল করতে জাদুবিদ্যা ব্যবহার করা হয়।

সাধারণত বিপক্ষ দলের সেরা খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বেশি টার্গেট করা হয়। তাই নিজেদের খেলোয়াড়দের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আফ্রিকান দলগুলো এই তান্ত্রিকদের মোটা অংকের বেতনে নিয়োজিত করতো। ব্যাপারটা অনেকটাই বর্তমান যুগের ভাইরাস-অ্যান্টি ভাইরাসের সঙ্গে মিলে যায়। 

আফ্রিকান ফুটবলে ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। কখনো কখনো দর্শকদের মধ্য থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক করার ঘটনা ঘটেছে। একবার এক ম্যাচে গ্যালারিতে বল চলে গেলে দর্শকরা সেটি নিজেদের মাঝে নিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর বলটি তারা ফেরত দিলেও প্রতিপক্ষের কোচ কালো জাদু করা হয়েছে দাবিতে সেই বলে খেলতে অস্বীকৃতি জানান। 

১৯৮০ সালে আফ্রিকান নেশনস কাপে মুখোমুখি গাম্বিয়া এবং সিয়েরা লিওনের মধ্যকার ম্যাচে ঘটে কিছুটা মজার ও অবাক করা ঘটনা। সে সময় গাম্বিয়ার ট্রেইনার ছিলেন হোলগার ওবারম্যান। ম্যাচ শুরুর আগে স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে দেখা যায় নীল রঙের পাউডার দিয়ে অনেকগুলো নকশা আঁকা রয়েছে। এটি দেখার পর ওবারম্যানের দলের খেলোয়াড়রা ভয়ে কাঁপতে থাকে। এছাড়া তারা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতেও অস্বীকৃতি জানায়। গাম্বিয়ার ফুটবলারদের দাবি ছিল, এই নকশাতে যারা পা ফেলবে তারাই ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। 

ইউরোপিয়ান হওয়ায় এগুলো বিশ্বাস করেননি ওবারম্যান। কিন্তু খেলোয়াড়রা কোনো কিছুতেই মানতে চাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় সকল খেলোয়াড়কে বাসে উঠিয়ে নিজেই পুরো বাসটিকে সজোরে প্রবেশপথে চালিয়ে দেন ওবারম্যান। অন্যদিকে খেলা শুরুর মাত্র দুই মিনিট আগে মাঠে আসে সিয়েরা লিওন। ম্যাচটিও তারা জিতে নেয় ২-০ গোলে।

কালো জাদুর উদাহরণ টানলে উঠে আসে আরেকটি ম্যাচের কথা। ৯০ এর দশকে একটি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা। খেলার প্রথম থেকেই দুর্বল রুয়ান্ডার ওপর চেপে বসে উগান্ডা। প্রথমার্ধে লক্ষ্যে ৫টি শট নিলেও একটি গোলও হয়নি। এর মাঝে ৩টি শট ক্রসবারে লাগে, বাকি দুটি শেষ সময়ে বাঁক পরিবর্তন করে। অর্থাৎ কোনো অজানা কারণে অল্পের জন্য বারবার বেঁচে যাচ্ছিলো রুয়ান্ডা।

হঠাৎ ক্যামেরায় দেখা যায়, রুয়ান্ডার গোলকিপারের পেছনের জালে সুতো দিয়ে এক জোড়া গ্লাভস বাঁধা। দর্শক ও উগান্ডার খেলোয়াড়দের মতে, এই গ্লাভসই রুয়ান্ডাকে গোল খাওয়া থেকে বারবার বাঁচাচ্ছিল। একপর্যায়ে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাঠেই দর্শক ও খেলোয়াড়দের মাঝে মারামারি শুরু হয়, আহত হয় অনেকে। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে আবার খেলা মাঠে গড়ায়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটিতে ১-০ গোলে জয়লাভ করে রুয়ান্ডা।

২০০২ সালে আফ্রিকা কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে ঘটে এমনই আরেক কাণ্ড। সেই ম্যাচে ক্যামেরুনের ট্রেইনার উইনি স্কার্ফের সহকারী থমাস কানুকে মাঠের এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে হাড় পুঁতে রাখতে এবং পানি ছিটাতে দেখা যায়। জাদুবিদ্যা করার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অবশ্য জেলে যাওয়াই মন্দের ভালো ছিল কানুর জন্য। কারণ প্রতিপক্ষ দর্শকদের কাছ থেকে এক পর্যায়ে মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন ক্যামেরুনের সাবেক এই খেলোয়াড়। 

আফ্রিকায় খেলে এমন খেলোয়াড়রাই যে কালো জাদুতে বিশ্বাস করেন এমন না। টোগো সুপারস্টার এমানুয়েল আদেবায়োর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য তার মা-ই দায়ী। এই ফুটবলার অভিযোগ করেছিলেন, ঝগড়ার জের ধরে দীর্ঘদিন ধরে তার উপর ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করে আসছেন মা।

আইভরি কোস্ট তারকা গ্র্যাডেল ২০১৩ সালে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ইনজুরির স্বীকার হন। এই অবস্থার জন্য তিনি তার বোন ডেবরাহকে দায়ী করেন। এই অভিযোগের ব্যাপারে ডেবরাহকে জিজ্ঞেস করা হলে তার উত্তর ছিলো, আমাদেরকে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য এটা হচ্ছে তার শাস্তি। ঘটনাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। 

অনেক তারকা খেলোয়াড়ই অবশ্য মাঠে কালো জাদুর প্রয়োগের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে কিছু কিছু ঘটনা এতটাই অলৌকিক যে তা বিশ্বাস না করাই কঠিন। কঙ্গোর বেনশাদি প্রদেশে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৮ সালে। সেবার স্থানীয় একটি প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বাসাংগার মুখোমুখি হয় বেনাশাদি। খেলা ১-১ সমতায় থাকা অবস্থায় ঘটে অবাক করা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আচমকা এক বজ্রপাতে একে একে ১১ জন খেলোয়াড় মাঠেই লুটিয়ে পড়েন। এছাড়া ৩০ জন দর্শক হন আহত। 

বজ্রপাতে মানুষ মারা যেতেই পারে। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো যে ১১ জন ফুটবলার মারা যান, তারা সবাই ছিলেন বেনাশাদি দলের। অন্যদিকে বিপক্ষ দল অর্থাৎ বাসাংগার খেলোয়াড়দের একটুও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। স্থানীয় মানুষরা এই ঘটনার জন্য বাসাংগা দলের জাদুবিদ্যাকেই দায়ী করে। এখনো এই ঘটনাটিকে ফুটবল মাঠে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ভুতুড়ে ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে ফুটবল খেলার ধ্যান ধারণায়। সবশেষ এমন বড় ঘটনা দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। সেবার রুয়ান্ডা প্রিমিয়ার লিগে মুকুরা ভিক্টোরি ও রায়ন স্পোর্টসের মধ্যকার ম্যাচে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল মুকুরা। রায়ন স্ট্রাইকার মুসা কামারার দারুণ একটি হেড অবিশ্বাস্যভাবে নিচে না নেমে উপরের দিকে ক্রসবারে গিয়ে লাগে।

ম্যাচের শেষ মিনিটে মুকুরা দলের গোলপোস্ট থেকে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে ছোট্ট এক অজানা বস্তু তুলে দৌড়ে মাঠের বাইরে দিয়ে আসেন মুসা। এই অপরাধে তাকে হলুদ কার্ড দেখানো হয়। তবে খেলা গড়াতেই গোল করে দলকে বাঁচিয়ে দেন মুসা। পরে প্রমাণিত হয় যে জাদু বিদ্যার কারণেই সেই ম্যাচে গোল পাচ্ছিল না রায়ন। 

এই ঘটনার পর ফুটবলে কালো জাদু বা যেকোনো ধরণের জাদু প্রয়োগের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তারপর এখন পর্যন্ত বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে যেখানে কালো জাদু চর্চা নিয়মিত বিষয়, সেখানে লোকের অগোচরে এখনো এসবের চর্চা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

বঙ্গবাণী/এমএস

খেলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত